করোনা ভাইরাস ও বাংলাদেশ - কেমন ছিল মহামারির সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো?

করোনা ভাইরাস ও বাংলাদেশ ঃ কেমন ছিল মহামারির সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলো? – Sheba Binimoy

সময়টা আজ ১২/০৩/২০২১ , শুক্রবার। চৈত্র মাসের অপরূপ সৌন্দর্যে এখন প্রকৃতি সেজেছে তার আপন রুপে। চৈত্রের প্রখর খরদাহ ও ঝড়ের তাণ্ডবতায় সর্বনাশের বাঁশি কখন যে বেজে ওঠে, কে জানে! তবুও চৈত্র মানে বসন্তের অপরূপ বৈভব। প্রকৃতির মাতাল আলোড়নের মাস এই চৈত্র। যদিও সময়টা এখন তোমাদের কত সাল চলছে বা বাংলার কোন মাস চলছে তা আমার জানা নেই! হয়ত আমার এই লেখার প্রায় অনেক বছর পর তোমরা এই লেখাটা পড়ছ। তবে যেই সময় বা পরিস্থিতির মধ্যে ব্লগটি লেখা হয়েছিল তা তোমাদের আজকের দিনগুলোর মত স্বাভাবিক ছিলনা। তবে কি হয়েছিল তখন? জানতে চাও? বলব আজ তোমাদের সেই করোনা ভাইরাস ও মহামারির সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোর কথাই!

https://www.dw.com/bn/

করোনা মহামারি ও বিশ্ব

তোমরা যেমন আজ স্বাভাবিক গতিতেই, হাসিখুশি মাখা জীবন নিয়ে এক সুন্দর পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছ, ঠিক ২০২০ সালের মার্চ মাসের আগ পর্যন্ত আমাদের জীবনযাপন ও ছিল তেমনই স্বাভাবিক। কর্মজীবী মানুষদের প্রতিদিন সকালে জীবীকার তাগিদে বেড়িয়ে পরা, দল বেঁধে শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া, পথে ঘাটে বাজারে অগণিত মানুষের কোলাহল কিংবা বন্ধুরা মিলে কোথাও দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়া সবকিছুই চলছিল তার আপন গতিতে। যদিও চীন দেশে তখন কি এক ভাইরাসের সন্ধান মিলেছে বলে গণমাধ্যমগুলোতে প্রচার হচ্ছিল, তাতে আমাদের কি? আমাদের দেশে তো আর ভাইরাস মেলেনি! এমন চিন্তাভাবনাই ছিল লোকের। আড্ডায় কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় চীনের ভাইরাস নিয়ে তখন চলছিল নানারকমের ট্রল আর হাসিঠাট্টা! কেউ বলছিল এটা গুজব, কেউ বলছিল ও তেমন কিছুনা, কেউবা বলছিল এটা চীনের উপর সৃষ্টিকর্তার প্রদত্ত আজাব, যেহেতু চীনের উইঘুর মুসলিমদের উপর দীর্ঘকাল ধরে সেখানকার শাসকগোষ্ঠীরা বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন করে আসছিল। তবে সে যাই হোক, নাম ছিল তার করোনা ভাইরাস। চীনের উহানের ল্যাব থেকে উতপত্ত ভয়ঙ্কর সেই ভাইরাসটি দাবানলের মত একে একে যেন ছড়িয়ে পরল পুরো পৃথিবী জুড়ে। প্রথম দিকে চীন ভাইরাসের তীব্রতা বা প্রখরতার বিষয়টি বিশ্ববাসীর কাছে গোপন করার চেষ্টা করে, যার কারনে অনেক দেশই সতর্কমুলক জরুরী পদক্ষেপ গ্রহন করার পূর্বেই তা চীন থেকে বিভিন্ন মানুষের অন্যদেশে ভ্রমন কিংবা ব্যবসার কাজে অন্যদেশগুলো থেকে চীন দেশে মানুষের আগমনের ফলে, করোনা মহামারি যেন খুব অল্পসময়ের মাঝে পুরো বিশ্বটাকে গ্রাস করে ফেলে। প্রতিদিনই বাড়তে শুরু করল মৃত্যুর মিছিল। প্রথমে শতক, এরপর হাজা্র, লক্ষ , কোটি! মনে হয়েছিল, এই মৃত্যুর মিছিল যেন এবার পৃথিবী থেকে মানবসভ্যতার চির বিদায়ের কারন হয়ে দাঁড়াবে।

করোনা মহামারি ও বাংলাদেশ ঃ

১৮ই মার্চ, ২০২০ বাংলাদেশে প্রথম একজন পুরুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স ছিল ৭০ বছর। মারা যাওয়া ব্যক্তি বিদেশ থেকে আসা ও সংক্রমিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে জানিয়ে ছিলেন আইইডিসিআর পরিচালক। আক্রান্ত ব্যক্তি অনেকটা গোপনেই বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সর্বশেষে, মিরপুরের কোন এক প্রাইভেট হাসপাতালে করোনার বিষয়টি চিকিৎসকদের কাছে লুকিয়ে রেখে কিছুদিন তিনি সেখানে চিকিৎসা নেন। এছাড়া তার করারই বা কি আছে! কোন হাসপাতালে যে তখন করোনা রোগী ভর্তি নেইনা! কারন রোগীদের সঠিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা চিকিৎসকদের কাছেও আকস্মিক এই ভয়ঙ্কর ভাইরাসটি যেন ছিল এক অতঙ্কের নাম। যাইহোক কোথাও আশানরুপ ফল না পেয়ে নিজ বাড়িতেই একটি কক্ষে নিজেকে আবদ্ধ করে যেন মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুনছিলেন। এক সময় মৃত্যুর কোলে যেন ঢলে পড়লেন সব আপনজনকে ছেড়ে। পরিস্থিতি তখন এমনই করুন ছিল যে, কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রন্ত হলে, লোকে তাকে ঘৃণা করত, দোষারোপ করত, গালিগালাজ করত। যেন করোনা রোগী হওয়ার থেকে তার আগেই মরে যাওয়া ভাল ছিল। এমনকি, বাবার মৃত্যুতে নিজ ছেলে, মেয়ে বা পরিবারের কেউ লাশ পর্যন্ত ছোঁয়ার বা লাশ গোসল করানোর মত সাহস ছিলনা। দেশের কিছু ধর্মপ্রাণ মুসলিম, স্বেচ্ছাসেবক তখন নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৃত ব্যক্তির গোসল, জানাজা ও দাফনের কার্যক্রম নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেই সময় আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে, নিজের থেকে মানুষ পৃথিবীর আর কাওকে বেশী ভালবাসে না, এমনকি নিজের বাবা – মাকেও না!

https://www.dhakatribune.com/

বাতাসে হাহাকার , লাশের গন্ধঃ (করোনা ভাইরাস ও বাংলাদেশ)

মসজিদগুলো থেকে প্রতিদিনই ভেসে আসত “শোঁক সংবাদ”। চারদিকে কান্নার বুকফাটা হাহাকার , আর নিশ্চুপ বাতাসে যেন দূর থেকে ভেসে আসত লাশের গন্ধ। পুরো পৃথিবীটাই যেন তখন চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে, যেন নিশ্চুপ নিথর হয়ে থমকে গেছে কোন এক অজানা ভয়ে।

এইদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ ২০২০ইং থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্য বেসরকারি প্রশাসনকে সহায়তা দিতে সেনাবাহিনী নিয়োজিত করা হয়। সাত দফায় ছুটি বাড়ানো হয়। করোনা মহামারী ঠেকাতে দেশকে লকডাউন করা হয়। বাধ্য হয়ে অনেক কোম্পানি তখন হোম অফিস শুরু করে।

পথঘাট ছিল শুন্য, কোথাও কোন জনবল নেই, নেই কোন কোলাহল। পথেপথে চলত পুলিশ, সেনাবাহিনীর মহরা। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হওয়ার কোন অনুমতি ছিলনা। এমনকি মুসলিম ধর্মাবলম্বীর প্রধান দুটি উৎসব “ঈদুল ফিতর” ও ঈদুল আযহার” মত দিনগুলতেও যেন ছিল শোঁকের মাতম। ঘরের কোনে আবদ্ধ হয়ে যার যার সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করাই ছিল মুক্তির অন্যতম পথ। জীবন- জীবীকার তাগিদে যেই মানুষগুলোকে প্রতিদিনই ঘর থেকে বের হয়ে আসতে হত, ঘর কোনে তখন তাদের বসে থেকে দু মুঠো ভাতের সাহায্যের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন পথ ছিলনা। এসময় সরকারের ত্রানের পাশপাশি, দেশের বৃত্তবান মানুষজন, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও অনেক স্বেচ্ছাসেবকরা এগিয়ে এসেছিলেন তাদের সাহায্যে। অন্যদিকে, ব্যবসা ও অর্থনৈতিক মন্দার কারনে করোনা মহামারী বহু মানুষের চাকরীচ্যুত হওয়ার কারন হয়। এতে সমাজের মধ্যম আয়ের পেশাজীবী মানুষগুলো পড়েছিল চরম বিপাকে। মূলত সবচেয়ে বেশী সমস্যার মধ্যে পরতে হয়েছিল মধ্যবিত্ত এই মানুষগুলোকে। কারন সমাজের এই শ্রেণীর মানুষগুলো নিজের সম্মান নিয়ে অনেক বেশী সচেতন। হাজার কষ্টেও তারা মুখ ফুটে কারও কাছে সাহায্যের আবেদন করতে পারেনা। পরিবারের সকলের ছোটখাট চাহিদাগুলো সবসময় পুরন করে নিজে কষ্টে থেকেও তাদের মুখে হাসি ফুটাতেই যেন তারা ভালবাসে। তাই এই শ্রেণীর মানুষগুলো যেন সবার চেয়ে আলাদা।

https://bdnews24.com/

চাকরীর বাজার মন্দা হওয়ায় অনেকেই এই সময়ে নিজের আত্মকর্মসংস্থান পথ বেছে নিতে অনলাইনে বিভিন্ন পণ্য বা সেবার ব্যবসা শুরু করেন। অনেকেই আবার তাদের অনলাইনে বিক্রয় বৃদ্ধি , ব্যাপক প্রসার ও অধিক ক্রেতা প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে দেশের নামকরা বিভিন্ন প্রোডাক্ট ও সার্ভিস লিস্টিং সাইটগুলোতে নিজেদের পণ্য বা সেবাগুলো সংযুক্ত করেন। এতে করে মহামারীকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছিল হাজার হাজার নতুন উদ্যোক্তা।

যাইহোক, ৬৬ দিন ছুটি থাকার পর ৩১ মে সীমিত আকারে সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত ও কলকারখানা খুলে দেওয়া হতে থাকে। যদিও তখন প্রতিদিনই নতুন করে করোনা সনাক্তের হার বাড়ছিল , বেড়ে চলেছিল মৃত্যু। কিন্তু একই সাথে দেশের মানুষের আর্থিক অবস্থা উন্নতির লক্ষ্যে এবং দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা হলেও সচল রাখাটা ছিল অত্যন্ত জরুরী। তাই সীমিত পরিসরে আস্তে আস্তে অফিস, আদালত, শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হয়। কিন্তু তখনও আতঙ্কের মাঝেই অতিবাহিত হচ্ছিল সাধারন মানুষের প্রতিটি দিন। জীবনের ঝুঁকি থকা সত্ত্বেও ব্যাপক স্বাস্থ্যবিধি মেনেই তবে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হত এবং অধিক প্রয়োজন না হলে ঘরে থাকারই পরামর্শ দেওয়া হত।

করোনার টিকাঃ (করোনা ভাইরাস ও বাংলাদেশ)

ঐদিকে করোনার টিকা আবিষ্কার করা নিয়ে চলে নানা আলোচনা সমালোচনা। রাশিয়া , চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই টিকা আবিষ্কার নিয়ে সর্বক্ষণ চলে নানা গবেষণা। করোনা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, এটা খুব দ্রুত তার জিন পরিবর্তন করে ফেলতে পারত, যার কারনে টিকা আবিষ্কার করাটা ছিল খুব চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। এবং সেই সময় প্রথম কোন বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক দেশে করোনা ভাইরাসের টিকা আবিস্কার করেছিল এবং তাদের তৈরি করা তিনটি ভ্যাকসিনকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভ্যাকসিন প্রি-ক্লিনিক্যাল ক্যান্ডিডেটের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল।

অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন নিয়ে যখন চলছিল অনেক জল্পনা – কল্পনা ঠিক তখনই প্রথম করোনার টিকা আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেই রাশিয়া। অনুমোদিত ভ্যাকসিনটি প্রথম প্রয়োগ করা হয়েছে রুশ প্রেসিডেন্টের মেয়ের দেহেই। এভাবে একে একে ধারাবাহিকভাবে টিকা আবিষ্কারে সফল হতে থেকে অন্যান্য দেশগুলো।

বাংলাদেশে করোনার টিকার আগমন (করোনা ভাইরাস ও বাংলাদেশ)

বাংলাদেশে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে ও করোনা মহামারী থেকে দেশকে নিরাপদ করতে ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট থেকে জানুয়ারি ২৫, ২০২১ সালে প্রথম চালানের ৫০ লাখ টিকা ঢাকায় এসে পৌছায়। ভ্যাকসিন প্রয়োগে প্রথমে জরুরি সেবাপ্রদানকারী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিক, সামনের সারির সেবাপ্রদানকারী, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, সাংবাদিক, শিক্ষক ও যাদের বয়স আঠারো বছরের ওপরে তাদেরসহ জনগণকে পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিন দেয়া হয়। এভাবে দেশে শুরু হয় ভ্যাকসিন প্রয়গের কার্যক্রম।

https://bdnews24.com/

সবকিছু এখন আগের চেয়ে অনেকটা স্বাভাবিক। প্রতিদিন এখনও নতুন করে আক্রান্ত বা মৃত্যুর সংবাদ আসছে। তবে বিষয়গুলো যেন আজ অতি স্বাভাবিক। যেন সকলেই অত্যন্ত কঠিন সময়ের মাঝে জীবন অতিবাহিত করে আর ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে এখন আর কোন ক্রমেই নিজেকে ঘর কোনে আবদ্ধ রাখতে পারছেনা। জীবিকার জন্য বা একটু প্রশান্তির জন্য পথে ঘাটে হুমড়ি খেয়ে পরছে সবাই। জীবন যেন খুঁজে পেতে চাচ্ছে তার আপন ঠিকানা।

Writer : Aminul Islam Ovi

About Author

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *